১৯৮৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামে শশাঙ্ক দেবনাথ নামের এক দরিদ্র সনাতন ধর্মাবলম্বী হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি কোথায় গেছেন, কেন গেছেন, কবে গেছেন কেউই জানেন না। পরিবার কিংবা গ্রামবাসী কেউই জানে না শশাঙ্ক কোথায় গেলেন।
.
তার প্রায় দু বছর পরের ঘটনা। ১৯৮৯ সাল তখন। শশাঙ্কের মতো এবার উধাও হয়ে গেলেন শশাঙ্কের গোটা পরিবারও।
.
একরাতের মধ্যেই হাওয়া সবাই। শশাঙ্কের পরিবারে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তান। গ্রামের মধ্যে রটে গেল মূলত শশাঙ্ক আগেই ভারতে চলে গেছে। দু বছর পর সুযোগ বুঝে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকেও এখন নিয়ে গেছে। এখানেই সমাপ্ত হলো প্রথম অধ্যায়ে।
.
তার মধ্যে স্থানীয় কেউ কেউ দাবী করে বসলো শশাঙ্ক তাদের কাছে তাঁর বাড়িঘর ও জমিজমা বিক্রি করে চলে গেছে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন পাশের গ্রামের কসাই তাজুল ইসলাম। তাজুল ইসলাম বললো যেহেতু শশাঙ্ক তার জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেয়নি সুতরাং এই জমি তার। একপর্যায়ে ঝগড়াঝাটি হলেও সময়ের ব্যবধানে তা একসময় মিটেও গেল।
.
গ্রামের লোকজন শশাঙ্ককে গালাগালি করে বলতে লাগলো, ‘মালোউনের বাচ্চা, এক জমি তিনজনের কাছে বিক্রি করে আ-কাডাগো দেশে পালাইছে। বেঈমান, মালাউন।’ কাহিনীটা তবে এখানে শেষ হলেও পারতো।
.
কিন্তু না। এখানেই ঘটনার শুরু। কিছুদিন পর গ্রামের স্কুল শিক্ষক আবুল মোবারক একদিন বিকেলে নৌকা যোগে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ধুপাজুড়ি বিলের পানিতে দুর্গন্ধযুক্ত তেল ভাসতে দেখেন। তিনি মাঝিকে নৌকাটা খানিক ঘুরিয়ে নিতে বলেন। হঠাৎ নৌকার নিচে কী একটা আটকে যাওয়ায় দুলে উঠে নৌকা। মাঝির বৈঠায় খটখট শব্দ হয়। কিছুটা সন্দেহ আবুল মোবারকের। মাঝি তখন বৈঠা দিয়ে পানির নিচে খোঁচাখুঁচি করতেই উঠে আসে একটি ড্রাম।
ড্রামটির মুখ আটকানো। চারদিকে ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ। বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় আবদুল মোবারক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বার সহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দিলেন। একপর্যায়ে ড্রাম খুলতেই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। ড্রামে তিনটি লাশ।
কারো কারো মনে সংশয় আরও বাড়লো। সন্ধান চললো আরও অনেকক্ষণ। একপর্যায়ে বিলেই পাওয়া গেল আরেকটি ড্রাম। সে ড্রামে টুকরো টুকরো করে রাখা আছে আরও তিনজনের লাশ । মোট ছয়টি লাশ!
.
এরা আর কেউ নয়, ঐ গ্রামেরই নিরীহ শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের লাশ ছিল এগুলো। শশাঙ্কের এক মেয়ে সুনীতিবালা শ্বশুরবাড়ি থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
.
তখন তদন্তে নামে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শশাঙ্কের জমি দখল করতে প্রথমে শশাঙ্ককে খুন করে লাশ গুম, এবং পরে এক রাতে পুরো পরিবারকেই নৌকায় তুলে নিয়ে মেরে ড্রামে ভরে বিলে পুতে ফেলা হয়। দিনে তারা প্রচার করছিল বিরজাবালার পরিবার ভারতে চলে গেছে।
.
তদন্তে দেখা যায় মূলত শশাঙ্কের সম্পত্তির উপর লোভ ছিল পাশের গ্রামের কসাই তাজুল ইসলামের। এ কারণেই প্রথমে অপহরণ করে শশাঙ্ককে হত্যা করেছিল সে। দুই বছর পর তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জনকে হত্যা করে ড্রামে চুন মিশিয়ে লাশ ভরে বিলে ফেলে দেয়া হয়। মনে রাখা ভালো, তাদের সর্বকনিষ্ঠ নিহত সন্তানের বয়স ছিল দুই বছর।
.
তখন তাজুলের বিচারের দাবীতে সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিলো।
.
আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে তাজুল এই হত্যাযজ্ঞের যে বিবরণ দিয়েছিলেন তা পড়তে গেলে যে কারোই গা শিউরে উঠবে। মানুষ যে কতোটা পাশবিক, নিষ্ঠুর ও ভয়ঙ্কর হতে পারে তা এই হত্যাযজ্ঞের জবানবন্দী প্রমান করে।
.
জবানবন্দীতে তাজুল বলেছিলো, ‘আমি শশাঙ্ক দেবনাথের সম্পত্তি দখল করার জন্য বিরজাবালা ও তার সন্তানদের হত্যা করার পরিকল্পনা করি। হত্যার ৫/৬ দিন পূর্বে পাঁচগাওয়ের বাজারের একটি কাঠের দোকানের পিছনে আমি আবদুল হোসেন ও বাগদিউয়ার হাবিবকে প্রথমে জানাই যে শশাঙ্কের সম্পত্তি দখলের জন্য বিরজাবালা ও তার সন্তানদের হত্যা করতে হবে।
.
আব্দুল হোসেন আমার কথায় রাজি হয় এবং সে ৩০ হাজার টাকা দাবী করে। আমি ২০ হাজার টাকা দিতে রাজি হই। এর পরের দিন বাজারের চায়ের দোকানে আবদুল হোসেন আমাকে টাকা যোগাড় করার করে বাগদা গ্রামের মোমিনের কাছে জমা রাখতে বলে। দুইদিন পর আমি মোমিনের নিকট প্রথম দিনে ১৫ হাজার টাকা জমা রাখি। একইসঙ্গে ঘটনার কাজে সহায়তা করার জন্য অন্যান্য আসামীকে নিয়োজিত করি।
.
৩রা সেপ্টেম্বর আবদুল হোসেন আমাকে জানায়, ঘটনার জন্য লোকজন প্রস্তুত এবং ৫ই সেপ্টেম্বর রাতে ঘটনা ঘটাতে হবে। আমি এখতারপুরের সহিদ মাঝির ইঞ্জিনের নৌকা ২০০ টাকায় ভাড়া করি। ৫ই সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক ১০টায় মোমিন, হাবিব, ইদ্রিস আলী, আলী আজম, আলী আহমেদ, শামসু, বাদশা, সুতা মিয়া, বেলু, ফিরোজ, আবদুল হোসেন, সৈয়দ মিয়া, জজ মিয়া, আবু সায়েদ, কাসেম, তাজন, হরিপুরের ফিরোজ, সহিদ, মানু মেম্বার এবং পরিচিত ৮/১০জন নৌকা যোগে, পায়ে হেঁটে আমার বাড়িতে আসে। তখন আমি একটি ছোট ঘরে শুয়ে ছিলাম। আবদুল হোসেন সেই ঘরে গিয়ে আমাকে সংবাদ দেয়।
.
তখন সব লোকজন এসে পৌঁছেছে। এরপর একটি ইঞ্জিন নৌকায় আমি, আবদুল হোসেন, ইদ্রিস আলী, বাগদিয়ার হাবিব বাদশা, ফিরোজ, কাসেম, ধনু, আলী আজম , আলী আহমেদ এবং বাকি চারজন উঠি। আমার হাতে একটা রামদা এবং অন্যদের হাতে লাঠি, বল্লম, টর্চ লাইট ছিল। মোমিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে দুটি ড্রাম, লবণ ও দুই মন চুন আগেই কিনে রেখেছিলো। ড্রাম, চুন ও লবণ ইঞ্জিনের নৌকায় রাখি।
.
রাত আনুমানিক ১২টায় দুটি নৌকাযোগে আমরা শশাঙ্কের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিই। নৌকা দুটি শশাঙ্কের বাড়ির পাশে ভিড়ে। নৌকায় দুজনকে পাহারায় রাখা হয়। বাকিরা সকলে শশাঙ্কের বাড়িতে উঠে আসি। ফিরোজ প্রথমে একটি লোহার শাবল দিয়ে বিরজাবালার ঘরের পিছনের জানালার রড বাঁকা করে ভিতরে প্রবেশ করে এবং ঘরের সামনের দরজা খুলে দেয়। আমরা কয়েকজন ভিতরে প্রবেশ করি। অন্যরা তখন বাইরে পাহারায়।
.
দরজা খোলার পর বিরজাবালা ও তার ছেলে মেয়েদের পশ্চিমের কক্ষে চৌকিতে ও মাটিতে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পাই। আমি ও আবদুল হোসেন বিরজাবালার মুখ চেপে ধরি। বিরজাবালার বড় মেয়ে সামান্য চিৎকার দিয়েছিল। বাকিরা বিরজাবালার ৫ ছেলেমেয়েকে মুখ চাপিয়ে কোলে করে নৌকায় উঠায়।
.
নৌকায় উঠানোর পর আবুল হোসেন বিরজাবালা ও তার ছেলেমেয়েদেরকে ধমক দিয়ে বলে শব্দ করলে কেটে ফেলবে। তারপর ইঞ্জিন নৌকাটি ধোপাজুরি বিলে যায়। ইঞ্জিন বিহীন নৌকাটি ইঞ্জিনের নৌকার পিছনে ছিলো। ধোপাজুরি বিলে নৌকা থামিয়ে আবদুল হোসেন ও ফিরোজ বিরজাবালাকে চেপে ধরে। আমি রামদা দিয়ে বিরজাবালার নাভী বরাবর দুই তিন কোপ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করি।
.
আলী আজম ও ফিরোজ বিরজার বড় মেয়ে নিয়তিকে চেপে ধরে, আবদুল হোসেন রামদা দিয়ে দুই কোপে মেয়েটিকে দ্বিখণ্ডিত করে। ধনু মিয়া বিরজার ছোট ছেলেকে গলা চেপে মেরে ফেলে। ফিরোজ আলী বিরজার ছোট মেয়েকে চেপে ধরলে আলী আজম দা দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে। বাদশা এবং হাবিব বিরজা ও শশাঙ্কের ছোট দুটি ছেলেকে কুপিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে।
.
বিরজাকে কাটার সময় শরীরে কাপড় ছিলোনা। তারপর খণ্ডিত দেহগুলিকে দুটি খালি ড্রামে ভর্তি করে লবণ ও চুন দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে পানিতে ডুবিয়ে রশি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখি। পরে রক্তরঞ্জিত নৌকাটি ধুয়ে ফেলি। আমি ও আবদুল হোসেন সবাইকে সতর্ক করে দিই, ঘটনা ফাঁস করলে বিরজাবালার মত পরিনতি হবে।
.
ঘটনার পরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমার চাচাতো ভাই মতিউর রহমানকে ৯ শতক নিজের জমি রেজিস্ট্রি করে দিই।
.
জবানবন্দীতে তাজুল বিরজার স্বামী অর্থাৎ শশাঙ্ককে হত্যার বিবরণও দিয়েছিল। শশাঙ্ককে তাজুল হত্যা করেছিল আরও দু বছর আগে। জবানবন্দীতে তাজুল সেই হত্যা সম্পর্কে বলেছিলো
‘দুই বছর পূর্বে এক শুক্রবার সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমি ও আমার জামাতা ইনু মিয়া শশাঙ্কের বাড়িতে যাই। শশাঙ্ককে জানাই তার মেয়ের জামাই মনা দেবনাথ ভারত সীমান্তে তার জন্য অপেক্ষা করছে। শশাঙ্ক তার কথা অনুযায়ী জামা পরে আমাদের সাথে বের হয়।
.
আমি এবং ইনু শশাঙ্ককে নিয়ে মাধবপুরের নিজনগর গ্রামে আজিদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। আজিদের বাড়ির একটি ঘরে শশাঙ্ককে বসিয়ে রাখি। আজিদ শশাঙ্ককে জানায় সীমান্তে স্পেশাল পার্টি কাজ করছে তাই এখন সীমান্ত পার হওয়া সম্ভব না। মধ্য রাতে পেরোতে হবে।
.
আনুমানিক রাত ১২টায় ঐ ঘরে আমি, ইনু, আজিদ এবং অপর দুইজন লোক শশাঙ্কের গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে হত্যা করি। আজিদ এবং অপরিচিত দুই ব্যক্তি শশাঙ্কের মৃতদেহ কাঁধে করে ভারতের চেহরিয়া গ্রামে নিয়ে যায় এবং একটি পরিত্যক্ত রিফিউজি ক্যাম্পের পাত কুয়ায় নিক্ষেপ করে চলে আসে।
.
এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দায়ে বিচারের রায়ে ফাঁসি হয়েছিলো তাজুল ও তাঁর সহযোগীদের। খুনি কসাই তাজুলের প্রতি মানুষের ঘৃণা-ক্ষোভ এতটাই ছিল যে, তার ফাঁসি কার্যকরের পর ঘরে ঘরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিলো।
.
তাজুলের লাশ কারাগার থেকে বের করার সময় ক্ষুব্ধ মানুষ থুথু ছিটিয়েছিলো, ছুঁড়ে মেরেছিল জুতা। প্রায় ৩৮ বছর আগেকার এ ঘটনাটি এখনো মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে আছে। ছয় খুনের ঘটনা মনে করলেই এখনো আঁতকে উঠেন সেখানকার মানুষ।
.
ঘটনাটি তখন এতোটাই আলোচিত হয়েছিল যে, এ নিয়ে পরবর্তীতে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘কাঁদে নিদারাবাদ’।